পৃথিবীতে মোট স্বাধীন দেশের সংখ্যা 195 টি। আমরা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম দশটি দেশ সম্পর্কে জানবো। যেগুলো হয়তো মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া অনেকটা কষ্টকর।
1: ভ্যাটিকান সিটি
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম দেশ ভ্যাটিকান সিটি ইতালির রোম শহরের মধ্যে অবস্থিত এই স্বাধীন দেশ। পোপ এখানকার রাষ্ট্রনেতা। এটি রোমান ক্যাথলিক গির্জার বিশ্ব সদর দপ্তর হিসেবে কাজ করে। সম্পূর্ণভাবে রোমের অভ্যন্তরে অবস্থিত দেশটি আয়তন 110 একর৷ দেশের জনসংখ্যা প্রায় 1 হাজার। আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ এটি। ধর্মগুরু পোপ ভ্যাটিকানের "সেরিমোনিয়াল চিফ"। এখানকার শাসন ব্যবস্থায় নিজস্ব একটি পদ্ধতি ও রীতি রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গির্জা সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা ভ্যাটিকান সিটিতে অবস্থিত। 1929 সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে।
2: মোনাকো
মোনাকোর তিন পাশেই আছে ফ্রান্স, অন্যদিকে ভূমধ্যসাগর। এই দেশের আয়তন 2 বর্গ কিলোমিটার। দেশটির জনসংখ্যা প্রায় 38,800 জন। এই দেশ আয়তনের দিক দিয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম এবং সর্বোচ্চ জনবহুল দেশ। দেশটি ফ্রান্সের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে ফ্রান্সের বেশ আধিপত্য রয়েছে দেশটির উপর। দেশটির ভাষা ফরাসি। এখানে রয়েছে বিখ্যাত মন্টি কার্লো ক্যাসিনো। এই ক্যাসিনোকে ঘিরে পৃথিবীর ধনী মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। এই ক্যাসিনোকে পৃথিবীর সবচাইতে নিরাপদ ক্যাসিনো হিসেবে ধরা হয় কিন্তু মোনাকোর স্থানীয় বাসিন্দাদের এই ক্যাসিনোতে ঢোকার অনুমতি নেই। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র গুলোর মাঝে মোনাকো অন্যতম। দেশটি নিরাপত্তার দিক দিয়ে বেশ শক্তিশালী। কোনো অপরাধের কথা শোনা যায় না। মোনাকো এতটা নিরাপদ হওয়ার মূল কারণ হলো দেশটির চারপাশে রয়েছে হাজার হাজার ক্যামেরা। দেশের মূল আকর্ষণ হলো ব্যবস্থা।
3: নাউরু
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম দ্বীপ রাষ্ট্রও এই নাউরু। বিশ্বের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ নাউরু অস্ট্রেলিয়ার পূর্বে অবস্থিত। এর আয়তন 21 বর্গ কিলোমিটার এবং একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। এটি বিশ্বের ক্ষুদ্রতম স্বাধীন গণতন্ত্রের দেশ। বিশ্বের কম জনবহুল দেশের মাধ্যে এটি দ্বিতীয়। এর জনসংখ্যা প্রায় 10,084 জন। নাউরু একটি স্বাধীন দেশ। এটি ফসফেট খনির দেশ। 1907 সাল থেকে এখানকার অর্থনীতির প্রধান আয় আসে ফসফেট খনিজ আকরিক থেকে। বর্তমানে খনিজ ফসফেট প্রায় শেষ হয়ে এসেছে আর এ কারণের বেকারত্বের হার দিন দিন বেড়ে চলেছে। 10 শতাংশ জনগণকে চাকরি দিয়েছে সরকার বাকি সবাই বেকার। দেশটি ছোট হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে শীর্ষ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।
4: টুভ্যালু
টুভ্যালু 5 টি প্রবাল এবং 4 টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি দেশ। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত। এর আয়তন 26 বর্গ কিলোমিটার। বিশ্বের চতুর্থ ক্ষুদ্রতম দেশটিকে স্বাধীন দেশ হিসেবে গ্ৰহণ করতে চায় না। টুভ্যালু বিশ্বের নিচু দেশগুলোর মাধ্যে একটি৷ সর্বোচ্চ চূড়াটি টি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 4.5 মিটার উচ্চতায় অবস্হিত। দেশটির আকার এবং অবস্থান বিশ্বের অন্য দেশের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দ্বীপটি ভবিষ্যতে ডুবে যেতে পারে। জাতিসংঘের 189 তম সদস্য দেশ টুভ্যালু। 1978 সালে স্বাধীনতা লাভ করে। দেশটির জনসংখ্যা প্রায় 10,640 জন। এখানে আয়ের বড় অংশ আসে ব্যবসা থেকে। অর্থনৈতিকভাবে প্রায় সবাই এখানে স্বচ্ছল।
5: সান মারিনো
এই ক্ষুদ্রতম দেশটি ইতালির মধ্যে অবস্থিত। শান্তিপ্রিয় দেশ সান মারিনো বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো সার্বভৌম রাষ্ট্র। এর আয়তন 61 বর্গ কিলোমিটার। দেশটি ইউরোপের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ। মারিনো নামে এক ব্যক্তি এবং তার সঙ্গে থাকা কিছু লোক এই স্থানটি খুঁজে পান। দেশটির জনসংখ্যা প্রায় 33,285 জন। দেশটিতে জনসংখ্যার চেয়ে গাড়ির পরিমাণ বেশি। জিডিপি অনুযায়ী দেশটি বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মাধ্যে একটি। দেশটির অর্থনৈতিক খাত মূলত পর্যটন, ব্যাংকিং এবং টেক্সটাইল নির্ভর। সান মারিনোর মাউন্ট তিতানো পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
6: লিখটেনস্টাইন
অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ডের মাঝে এই ছোট দেশটি অবস্থিত। এর আয়তন ১৬০ বর্গ কিলোমিটার। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় 37,340 জন। এই দেশটি আকারে ছোট হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের সর্বোচ্চ জিডিপি রয়েছে এই দেশে। বেকারত্বের হার প্রায় নাই বলেই চলে মাত্র 1.5 শতাংশ। বেশিরভাগ অধিবাসীরা রোমান ক্যাথলিক এবং সরকার রাজতন্ত্র আকারে গঠিত। লিখটেনস্টাইন হলো জার্মান ভাষার দেশ। কথিত আছে, বর্তমান সময়ের ঐতিহাসিক তথ্য, পূর্বাভাস, পরিসংখ্যান, চার্ট এবং অর্থনৈতিক ক্যালেন্ডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাকি এই ক্ষুদ্র দেশ থেকেই আমদানি করে থাকে। দেশটির বেশিরভাগই পাহাড়। বসবাসের সমতল ভূমি খুবই কম। পাহাড়ে ছোট ছোট শহর গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে প্রচুর আলপাইন গাছ রয়েছে। এটি ইউরোপের একমাত্র "double landlocked country" বা দ্বি স্তরীয় স্থলবেষ্টিত দেশ।
7: মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ
দেশটি প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত একটি দ্বীপপুঞ্জ। হাজার খানেক দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠা দেশটির মাত্র 24 টি দ্বীপ বসবাসের উপযোগী। এর আয়তন 181 বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা 53,066 জন। 1946 সাল থেকে 1958 সাল পর্যন্ত আমেরিকা 67 বার পারমাণবিক পরীক্ষা চালায় এই দ্বীপে। 1983 সালে "কম্প্যাক্ট ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন" চুক্তির মাধ্যমে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জকে একটি সার্বভৌম জাতি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দেশটির মুদ্রা হিসেবেও আমেরিকান ডলার ব্যবহার করা হয়। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও সংবিধানে সামরিক বাহিনী বা সেনাবাহিনী নেই। স্বচ্ছ নীল পানি এবং স্কুভা ডাইভিং এর জন্য পৃথিবী বিখ্যাত জায়গা এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি। 160 প্রজাতির কোরাল এবং 800 প্রজাতির মাছের দেখা পাওয়া যায় দেখা পাওয়া য়ায় এই দেশে।
8: সেন্ট কিটস এবং নেভিস
দেশটি ক্যারিবিয়ান সাগরের দুইটি দ্বীপ। 1948 সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস সর্বপ্রথম এখানে ভ্রমণ করেন৷ ইউরোপিয়ানরা সর্ব প্রথম এই দ্বীপপুঞ্জই দখল করেছিলো। ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দেশটি শাসন করে এবং একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে দীর্ঘকাল চেষ্টার পর 1713 সালে ব্রিটিশরা উপনিবেশ গড়ে তোলে। অবশেষে 1983 সালে যুক্তরাজ্য থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয়। মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেন্ট কিটস এবং নেভিস পশ্চিম গোলার্ধের একেবারে কোনায় অবস্থিত। ওয়েস্ট ইন্ডিস বা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ার মাতৃভূমি বলেই স্বীকৃত এই দেশ। এই দেশের জনসংখ্যা প্রায় 54,821 জন এবং আয়তন 261 বর্গ কিলোমিটার। দেশটির অল্প পরিসরে নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা এবং কারখানা রয়েছে। বেশিরভাগ মানুষই সমুদ্র সম্পদ নির্ভর।
9: মালদ্বীপ
ভারত মহাসাগরে অবস্থিত হাজার খানেক দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি দ্বীপরাষ্ট্র। এখানে প্রায় 1090টির মতো দ্বীপ থাকলেও বসবাসের যোগ্য মাত্র 200 টি দ্বীপ। দেশটির আয়তন 298 বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় 4,27,756 জন। খৃষ্টপূর্ব 5ম শতকে মালদ্বীপ অধিষ্ঠিত হয়৷ পর্তুগিজ, ডাচ এবং ব্রিটিশরা যথাক্রমে ষোড়শ, সপ্তদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীতে মালদ্বীপ শাসন করে। অবশেষে 1965 সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। মালদ্বীপ বিশ্বের সবচেয়ে নিচু দেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মালদ্বীপের সর্বোচ্চ উচ্চতা মাত্র দুই দশমিক তিন মিটার এবং গড় উচ্চতা এক দশমিক পাঁচ মিটার। বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে মালদ্বীপ পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিবছর সেখানকার সাদা বালির সমুদ্র সৈকতের টানে ভিড় করেন লাখো ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা এমনকি সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মালদ্বীপের মাথাপিছু আয় সবচেয়ে বেশি।
10: মাল্টা
রিপাবলিক অব মাল্টা মূলত ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত সাতটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি দ্বীপপুঞ্জ। তিনটি দ্বীপ মাল্টা, গজো, কমিনো ঘিরেই গড়ে উঠেছে বসতি। এই দ্বীপ তিনটি মাল্টার সবচেয়ে বড় দ্বীপ হিসেবেও পরিচিত। এর আয়তন 316 বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে 4 লক্ষ। দেশটি বিশ্বের ঘনবসতি পূর্ণ দেশ গুলোর মধ্যে একটিতে পরিণত করেছে। দেশটির ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য রয়েছে যথেষ্ট। 1968 সালে মাল্টা যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। বর্তমানে পর্যটন শিল্পই দেশটির প্রধান আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করে। এর উষ্ণ আবহাওয়া, অসংখ্য বিনোদন স্পট এবং ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যসহ নানা ঐতিহাসিক স্থাপনার কারণে পর্যটকদের কাছে দেশটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। আয়তনের দিক দিয়ে দশম স্থানে রয়েছে।