ভয়ংকর কয়েকটি ভাইরাস
ভাইরাস হলো এক ধরনের অণুজীব। ভাইরাস একটি লাতিন শব্দ যার অর্থ হচ্ছে "বিষ"। এই অতি ক্ষুদ্র অণুজীবের আছে ভয়ংকর মারণ ক্ষমতা। পৃথিবীতে আসা ভয়ংকর এই ভাইরাস খুব সহজেই একজন থেকে অন্যজনের শরীরে সংক্রমণ ঘটায় আর নতুন হওয়ার কারণে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কাজে আসে না এবং তাৎক্ষণিকভাবে এর চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহন সম্ভব হয় না। তাই যখন কোনো ভাইরাস বিশ্বের বিরাট অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, অস্বাভাবিক সংখ্যায় মানুষ আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় তখন তা মহামারি আকার ধারণ করে। পৃথিবীতে আসা ভয়ংকর কয়েকটি ভাইরাস সম্পর্কে জানবো যা মহামারি আকার ধারণ করেছিল এবং প্রাণ হারিয়েছিল লাখ লাখ মানুষ।
নভেল করোনা ভাইরাস (Novel coronavirus)
করোনাভাইরাস আসলে একক কোনো ভাইরাস নয়। এটি বেশকিছু ভাইরাস প্রজাতির বড় একটি পরিবার। সার্স, মার্সের মতো প্রাণঘাতী ভাইরাসগুলোও এ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এ পরিবারের ভাইরাসগুলো প্রাণী থেকে মানুষে এবং মানুষ থেকে প্রাণীতে সংক্রমিত হতে পারে। এ পরিবারের নবীনতম সদস্য হলো নোভেল করোনা ভাইরাস।
1918 সালের স্প্যানিশ ফ্লুর প্রায় 102 বছর পর 2020 সালের শুরুতেই চীনের উহান শহর থেকে শুরু হয় নতুন ধরনের অজ্ঞাত এই প্রাণঘাতি "Novel coronavirus" এর প্রাদুর্ভাব। এই প্রাণঘাতী নভেল করোনা ভাইরাসটি ইতিমধ্যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। অজ্ঞাত এই ভাইরাস সম্পর্কে শুরুতে কোনও প্রকার তথ্য না জানা থাকায় এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্টভাবে এর প্রতিষেধক উদ্ভাবন সম্ভব হয়নি। চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাসের কারণে থমকে গেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। দুনিয়াজুড়ে মৃতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এমতাবস্থায় বিশ্বজুড়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা "WHO"।
চীন ইতিমধ্যেই এই ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। দেশটিতে নতুন করে সংক্রমণের কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এর মধ্যে এর ভয়াল থাবা দেখতে শুরু করেছে পশ্চিমা বিশ্বের পাশাপাশি এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় ওপরের সারিতে থাকা অন্যতম দেশগুলোর মধ্যে ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যে, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়ার নাম উল্লেখযোগ্য।
15 জুলাই 2021 এর সর্বশেষ তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় 18 কোটি 9 লাখ এবং মৃতের সংখ্যা প্রায় 40 লাখ 70 হাজার। তবে ধারণা করা হচ্ছে এর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে এবং এর সময়কাল সম্পর্কে এখনো কোনো নির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া যায় নি।
স্প্যানিশ ফ্লু (Spanish flu)
1820 সালের কলেরার প্রায় 98 বছর পর 1918 সালের শেষের দিকে ভয়ঙ্কর এক মহামারি সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল যার নাম ছিল স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর ফ্লু স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত। স্প্যানিশ ফ্লুর কারণ ছিল "H1N1" ভাইরাস। এর নাম স্প্যানিশ ফ্লু হলেও এর উৎপত্তি ছিল মূলত আমেরিকা। এই ফ্লু প্রথম দেখা গিয়েছিল 1918 সালের 4 মার্চ কানসাসের আমেরিকান সেনা সদস্যদের মধ্যে। স্প্যানিশ ফ্লু নামকরণের পেছনে কারণ হলো স্পেনের সংবাদ মাধ্যম এই ফ্লুর খবরটি মুক্তভাবে পরিবেশন করছিল। স্প্যানিশ ফ্লু যখন মহামারিতে রূপ নেয়, তখন বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম সেই সংবাদ প্রচারে বাধা-নিষেধ আরোপ করলেও স্পেনের মিডিয়া ফলাও করে এই ফ্লুর কথা প্রচার করেছিল।
তাই এই মহামারির নাম হয়ে যায় "Spanish flu" যদিও এর প্রভাব ছিল পুরো ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা জুড়েই। 1918 সালে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া শুরু করে ভাইরাসটি এবং পরের দুই বছরে সারা পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার 40 শতাংশই এতে আক্রান্ত হয়। মৃত্যু হয়েছিল পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষের যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যার চাইতেও বেশি। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল যে ট্রলিতে বোঝাই করে লাশ শহর থেকে সরাতে হয়েছে, মৃতদেহ দাফনের জন্য কোণ গির্জা কিংবা যাজক পাওয়া যেত না এবং কবর খোড়ার মতো লোক পাওয়া ছিল দুষ্কর ব্যাপার। 1918 সালের মতো আবারো নতুন কোনো ফ্লু মহামারী ছড়িয়ে পড়া অসম্ভব কিছু না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা এখন ইনফ্লুয়েন্জা অতটা মারাত্মক না হলেও বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় 5 লাখ মানুষ ইনফ্লুয়েন্জার কারনে মারা যায়।
কলেরা ( Cholera )
1720 সালের প্লেগ-এর ঠিক 100 বছর পর 1820 সালে ভয়ঙ্কর রূপে ফিরে আসে কলেরা। 1817 সালে শুরু হয়ে 1824 সাল পর্যন্ত এর প্রভাব থাকলেও 1820 সালে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায়। "Asiatic cholera" নামে পরিচিত এই অতি মহামারির শুরু কলকাতার ব্রিটিশ সেনাদের মাঝে। পরে তা প্রায় অর্ধেক পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। 1817 থেকে 1881 সালের মধ্যে মোট পাঁচবার কলেরা-র প্রাদুর্ভাব হয়েছিল ভারতে। মূলত এই কলেরা-তে আর্থিকভাবে দুর্বল শ্রেণির মধ্যে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি ছিল। ভারতে বসবাসকারী ইউরোপিয়ানরা সেভাবে এতে প্রভাবিত হয়নি।
মূলত বন্যা থেকে এই রোগের উৎপত্তি হয়েছিল। তৎকালীন এক ভয়াবহ বন্যার পরেই জলবাহিত পেটের অসুখে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। এই মহামারিতে কত লাখ লোক মারা গিয়েছিলেন তা পরিস্কার ভাবে জানা যায় নি। ইতিহাসবিদদের মতে, সেই সময়ে অল্পদিনের ব্যবধানে হাজার হাজার আক্রান্ত ব্যক্তিরা মারা যান। প্রতিদিনের আক্রান্তের সংখ্যা এমন হারে বেড়েছিল যে টা রীতিমতো ভয়ানক ছিল।বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে সে সময় চীন, রাশিয়া ও ভারতে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে অন্তত 4 কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে।
প্লেগ অব মার্সেই (The Plague of Marseille)
ইতিহাসের তথ্যমতে, সপ্তদশ শতকে দুনিয়াজুড়ে 20 কোটি মানুষ শুধু প্লেগ রোগে মারা যায়। 1347 সালে প্রথম বড় বুবোনিক প্লেগ সংক্রমণ ঘটে। প্লেগ ইউরোপে কয়েক শতাব্দীকাল ধরে টিকে ছিল যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াল রূপটি ছিল 1720 সালে ফ্রান্সের "The Plague of Marseille" এর মহামারির আঘাত। এই প্লেগে শুধু মার্শেই নগরীতে 50 হাজার আর পুরো ভলকান ও ফ্রান্সজুড়ে 10 লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ফ্রান্সের জন্মহার প্রায় 45 বছরের জন্য কমে গিয়েছিলো এই প্লেগের প্রভাবে। এই সংক্রমণের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল ভারতেরও তবে অনেক পরে।
পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো একক রোগে এত মানুষের মৃত্যু এর আগে কখনো ঘটে নি। তাই এই মৃত্যুর ঐতিহাসিক নাম দেওয়া হয়েছিল "The Black Death"। এ সময় পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে, মৃতদেহ কবর দিতে খোড়া হয় একের পর এক গণকবর। এই মহামারি ইউরোপের ইতিহাসে ব্যাপক ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। ইতিহাসবিদরা ধারনা করেন এই মহামারীর চূড়ান্ত পর্যায়ে পৃথিবীজুড়ে প্রতিদিন গড়ে 30 থেকে 40 হাজার মানুষ মারা যেত! ইউরোপের সমাজ কাঠামো ভেঙে দিয়েছিল এই প্লেগ। ধারণা করা হয় যে এই ব্যাক্টেরিয়া সংক্রামিত মাছি বা ইঁদুর দ্বারা ছড়িয়ে পড়ে।
ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যাচ্ছে প্রতি 100 বছর পরে নিজেকে পুনরাবৃত্তি করছে এই ভয়ংকর ভাইরাস। এটি কি কেবল কাকতালীয় ঘটনা নাকি অন্য কিছু তা হয়তো সময়ই বলে দিবে।