সুইস ব্যাংক কি? কেন এত জনপ্রিয়? সুইস ব্যাংক বলতে কি বোঝায়?


কেন এই সুইস ব্যাংকগুলো এত জনপ্রিয় ?

এর প্রধান কারণ, প্রাইভেসি এবং স্থিতিশীলতা। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং সিস্টেমকে পৃথিবীর অন্যতম স্থিতিশীল ব্যাংকিং সিস্টেম বলা হয়। তাছাড়া সেখানে ক্লায়েন্টদের গচ্ছিত অর্থ সম্পদের সর্বোচ্চ তথ্যগত নিরাপত্তা দিয়ে আসছিলো সুইস ব্যাংকগুলো। আজ থেকে 300 বছর আগে থেকেই এই ধরণের গোপন একাউন্ট খুলে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে টাকা রাখার ব্যাপারটি প্রচলন হয়েছে। ইতিহাস বলে, মূলত "France" এর রাজাদের সঞ্চিত অর্থ গোপন রাখার প্রবণতা থেকে শুরু হয়েছিলো এই ধরণের ব্যবস্থা। তাছাড়া 1713 সালের জেনেভা সিটি কাউন্সিলের একটি আইন এই গোপনীয়তাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, কোনো গ্রাহকের একাউন্টের তথ্য সে ছাড়া আর কেউ জানবে না। গ্রাহকের একাউন্ট তথ্য সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রাখার নীতিমালা করা হয়েছিলো। তখন ব্যাংকের কাছেও নিজের নাম পরিচয় ঠিকানা গোপন করে একাউন্ট খোলা যেতো।


ফলে তখন থেকেই বিভিন্ন দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ এসে জমা হতে থাকলো সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে। যদিও বর্তমানে ব্যাংকের কাছে পরিচয় গোপন রাখার অপশন নেই। তবে নাম্বার একাউন্ট এর ব্যবস্থা আছে। এই একাউন্টে গ্রাহকের নাম ধামের পরিবর্তে তাকে নির্দিষ্ট কিছু গোপন নাম্বার দেয়া হবে যা তার গোপনীয়তা রক্ষা করবে। ব্যাংকের খুব কম মানুষই জানবে এই নাম্বারের পেছনের মানুষটি কে! সুইস ব্যাংকগুলোতে কার কত অর্থ জমা আছে এধরণের তথ্য সাধারণত তারা প্রকাশ করে না। এসোসিয়েশন অব সুইস প্রাইভেট ব্যাংকার্স এর প্রধান "Michelle D. Robert" গোপনীয়তার ব্যাপারে বলেন, একজন ডাক্তার কিংবা আইনজীবি যেভাবে ক্লায়েন্টের তথ্য গোপন রাখে এখানেও ব্যাপারটি একই। সুইস ব্যাংক তার ক্লায়েন্টের তথ্য কাউকে দিতে বাধ্য নন, এটা রীতিমতো নীতি এবং আইনবিরুদ্ধ। আর এই কারণেই সুইস ব্যাংকগুলো এতটা জনপ্রিয়।


সুইস ব্যাংক বলতে কি বোঝায় ?

1854 সালে সুইস ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে 1998 সালের পর থেকে সুইস ব্যাংক বলে আর কিছু নেই। সে বছর সুইস ব্যাংক ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ড এর সাথে একীভূত হয়ে যায়। বর্তমানে ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ড গোটা ইউরোপের মধ্যে সবচাইতে বড় ব্যাংক এবং সারা বিশ্বে এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক। সুইস ব্যাংক বলে আপাতত এখন কোনো একক ব্যাংক এর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু "Swiss Financial Market Supervisory Authority" এর অধীনে সুইজারল্যান্ডের সকল ব্যাংকই সুইস ব্যাংক বলে পরিচিত। তার মধ্যে আছে "Union Bank of Switzerland, Credit Suisse" ইত্যাদি।


যে ধরণের একাউন্ট খোলা যায়

অন্যান্য সাধারণ ব্যাংক এর মতোই এখানেও চলতি হিসাব, সঞ্চয়ী হিসাব সহ বিভিন্ন একাউন্ট খোলা যায়। তবে বিদেশী নাগরিকদের জন্য সুইস ব্যাংকগুলো ইনভেস্টমেন্ট একাউন্ট খুলতে উৎসাহিত করে।


সুইস ব্যাংকে একাউন্ট খোলার যোগ্যতা

একটা তথ্য দেই। 2016 সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল 66 কোটি 10 লাখ সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় 5 হাজার 685 কোটি টাকা! ধারণা করা হয় এর অধিকাংশই পাচারকৃত কালো টাকা। বিভিন্ন দেশ থেকে রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, মাফিয়া, ক্রিমিনাল সহ কোটিপতিরাই মূলত অর্থ পাচার করে সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা রাখে। অনেকের ভুল ধারণা যাদের অনেক অর্থ তারাই কেবল সুইস ব্যাংকগুলোতে টাকা রাখতে পারে। কোটিপতি না হলে এখানে ব্যাংক একাউন্ট খোলা যায় না। আসলে এটি একটি ভুল ধারণা মাত্র।


আপনি যদি সৎ হন তাতে নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। সুইস ব্যাংকগুলোতে প্রচুর সাধারণ মানুষের একাউন্ট আছে। যেসব দেশের সরকার ব্যবস্থা অস্থিতিশীল এবং অর্থনীতি ভঙ্গুর এমন দেশগুলোর মানুষেরা সুইস ব্যাংকগুলোতে একাউন্ট খোলে আর্থিক নিরাপত্তার কারণে। শুধু অবৈধ অর্থ রাখা কিংবা অর্থের গোপনীয়তাই কিন্তু একাউন্ট খোলার মূল উদ্দেশ্য না। 18 বছর বয়সী যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সুইস ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে পারে। একাউন্ট খোলার পর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ একাউন্টে জমা রাখতে হয়, এটি ব্যাংক ভেদে ভিন্ন হয়।


ইনভেস্টমেন্ট একাউন্ট খোলার নিয়ম

যিনি একাউন্ট খুলতে চান তিনি অথবা তার প্রতিনিধিকে প্রথমেই পছন্দের সুইস ব্যাংকটির যেকোনো একটি শাখায় ভিজিট করতে হবে। প্রতিনিধি পাঠালে প্রতিনিধি এবং যার নামে একাউন্ট তার তথ্য ব্যাংককে দিতে হবে। অফিস বা নিজ প্রতিষ্ঠানের সত্যায়িত আইডি কার্ডের ফটোকপি, পাসপোর্টের ফটোকপি ব্যাংকের কাছে জমা দিতে হবে। কিছু ব্যাংক অবশ্য এই প্রক্রিয়াটি "E-mail" মাধ্যমেই করে। তবে অন্যান্য ব্যাংকের মতো সুইস ব্যাংকগুলোও অর্থের উৎস যাচাই করতে চাইতে পারে। সেক্ষেত্রে ব্যাংককে আয়ের উৎসের ডকুমেন্টও প্রদান করতে হবে। আপনি একাউন্ট খোলার সময় বললেন, আপনি "বাড়ি বিক্রি" করে টাকা পেয়েছেন। সেক্ষেত্রে বাড়ি বিক্রির রশিদ ব্যাংক চাইতে পারে। তাছাড়া ব্যাংক যদি সন্দেহ পোষণ করে আপনার ডকুমেন্টের সাথে দেয়া ঠিকানাও ভেরিফাই করতে পারে।


অতঃপর ব্যাংকের দেয়া আবেদনপত্রের কাগজপত্র আপনাকে পূরণ করতে হবে। সম্প্রতি আন্তজার্তিক চাপের কারণে এবং বিভিন্ন দেশে কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় একাউন্ট খোলার প্রক্রিয়াটি বেশ সময় নিয়েই করে ব্যাংকগুলো। একজন বিদেশী নাগরিককে ইনভেস্টমেন্ট একাউন্ট খুলতে প্রায় 100 পাতার কাছাকাছি পেপারওয়ার্ক করতে হয় আবেদন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। এছাড়া ব্যাংক একাউন্ট অনুমোদন পেতে হলে নির্দিস্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। বর্তমানে কিছু প্রাইভেট সুইস ব্যাংকে নতুন ইনভেস্টমেন্ট একাউন্ট খুলতে "আড়াই লাখ ডলার" বিনিয়োগ করতে হয়। তবে কিছু ব্যাংকে "পঞ্চাশ হাজার ডলার" হলেই একাউন্ট খোলার অনুমোদন পাওয়া যায়। তবে বিনিয়োগের এই পরিমান দেশভেদে ভিন্ন যেমন: কানাডার কেউ সুইস ব্যাংকের ইনভেস্টমেন্ট একাউন্ট খুলতে হলে জমা রাখতে হবে "দুই মিলিয়ন ডলার"


নাম্বারড একাউন্ট খোলার নিয়ম

গোপনীয়তা রক্ষা যদি একাউন্ট খোলার মূল কারণ হয় তাহলে নাম্বারড একাউন্ট খোলাই শ্রেয়। ব্যাংকের কিছু হাই অফিশিয়াল কর্মকর্তা ছাড়া এই একাউন্টগুলোর তথ্য আর কেউ জানে না। যদি কেউ নাম্বারড একাউন্ট খুলতে চায় তাকে সশরীরে উপস্থিত থাকতে হবে এবং উপরে উল্লিখিত ফর্মালিটিজগুলো শেষ করতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় কমপক্ষে "এক লক্ষ ডলার" ডিপোজিট করতে হবে। আর বছরে 300 ডলার গুনতে হবে শুধুমাত্র একাউন্ট মেইনটেইনেন্সের জন্যে!


ব্যাক্তিগত একাউন্ট খোলার নিয়ম

এই একাউন্ট খোলার ক্ষেত্রেও পূর্বের মতো ব্যাংকের কোনো শাখায় ভিজিট করতে হবে। যারা সুইজারল্যান্ডে নতুন তারা উপরিউক্ত ডকুমেন্ট সহ নিজে উপস্থিত থেকে একাউন্ট খোলার আবেদন করবে। যারা সুইজারল্যান্ডের বাইরে থেকে ব্যাক্তিগত একাউন্ট খুলতে চায় তাদেরকে একাউন্ট খোলার প্রক্রিয়াটি মেইলের মাধ্যমে করার অনুরোধ জানাতে হবে। তারপর আপনাকে একজন ব্যাক্তিগত একাউন্ট ম্যানেজারের সাথে যুক্ত করে দেয়া হবে। কে আপনার ম্যানেজার এটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে পরবর্তী ট্রানজেকশনের জন্য। তাই ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য তার মেইল এড্রেস, ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে রাখতে হবে। ব্যাক্তিগত একাউন্টয়ের রক্ষণাবেক্ষণ ফি বাবদ প্রতি মাসেই "10-30 সুইস ফ্রা" গুনতে হয়। এছাড়া Debit, Credit Card থাকলে তার জন্যেও অতিরিক্ত ফি দিতে হবে।


আরও কিছু তথ্য

আপনি যদি চান আপনার অর্থের উৎস কেউ না জানুক তাহলে এমন সুইস ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে হবে যার শাখা আপনার দেশে নেই। এছাড়া একাউন্ট ট্র্যাক ডাউন হওয়ার ভয় থাকলে "Debit card, Credit Card, Check" এর সুবিধা নেয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে ট্রাভেলার্স চেকের মাধ্যমে একাউন্ট অপারেট করতে হবে। তবে একটি সতর্ক বার্তা না দিলেই নয়। সুইস ব্যাংক যদি মনে করে আপনার অর্থের উৎসে ঝামেলা আছে এবং এই অর্থ "Drug Business" থেকে আসা তাহলে তারা একাউন্ট খোলার অনুমতি নাও দিতে পারে। ভারতে বিগত কিছু বছরে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমার হার অর্ধেক হয়ে গিয়েছে কেবল এই কারণেই। শুধু সুইস ব্যাংকই নয়, বিশ্বে আরো অনেক সিক্রেট ব্যাংক রয়েছে যেগুলো অ্যাকাউন্টের গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষা করে এবং ট্যাক্স হেভেন হিসেবে কাজ করে।


এ ধরনের সবচেয়ে সুপরিচিত যেসব সিক্রেট ব্যাংকের নাম করা যেতে পারে সেগুলোর মধ্যে আছে "Anglia, Belize, Bahamas, Cayman Islands and Panama" ব্যাংকগুলো। অ্যাংগুলিয়া হচ্ছে একটি পূর্ব ক্যারিবিয়ান ব্রিটিশ টেরিটরি। এটিকে বিবেচনা করা হয় একটি অফশোর বিজনেস সেন্টার ও "Tax-Free" জোন হিসেবে। বেলিজ অফশোর ব্যাংকিংয়ের সুযোগ দিয়ে আসছে সেই 1995 সাল থেকে। এসব ব্যাংকের অ্যাকাউন্টগুলো স্থানীয় করের আওতাভুক্ত নয়। এর গ্রাহকদের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। যদি বেলিজের কোর্ট মনে করে কোনো অ্যাকাউন্টের অর্থ অসদুপায়ে আসছে তবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে সে ব্যাপারে তথ্য প্রকাশ করতে হয়। প্রকাশ করতে হয় হিসাবধারীর পরিচয়ও। বাহামার ব্যাংকে গোপনীয়তা অন্যান্য দেশের মতো ততটা কঠোর নয়।

Collect Your Code "2"


দেশটির নতুন ব্যাংক আইন ব্যাংকগুলোকে সুযোগ দিয়েছে হিসাবধারী ব্যক্তির ও কোম্পানির তথ্য গোপন রাখার। "Cayman Islands" রয়েছে সুইজারল্যান্ডের মতো ব্যাংকসংশ্লিষ্ট জোরালো প্রাইভেসি আইন। সেখানে কোনো কর্মকর্তা হিসাবধারীর গোপনীয়তা ভঙ্গ করলে তাকে কারাগারে যেতে হয়। অনেকেই পানামাকে দেখেন ব্যাংক অ্যাকউন্টের গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে একটি স্থিতিশীল দেশ হিসেব। সেইফ হেভেন হিসেবে একক খ্যাতির দাবিদার হচ্ছে "সুইস ব্যাংক"। বৈধ ও অবৈধ অর্থের আধার হচ্ছে এই সুইস ব্যাংক। সে কারণে অনেকেই সুইস ব্যাংককে দেখেন "Red Flag" তথা মহাবিপদ হিসেবে। বিশেষ করে সুইস ব্যাংককে এই অভিধায় অভিহিত করেন পুঁজিবাদবিরোধীরা। কারণ এরা মনে করেন, পুঁজিবাদ সম্প্রসারণের এক লালন ক্ষেত্রও হচ্ছে এই সুইস ব্যাংক।


পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আসসালাম অলাইকুম

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post