ঘটনাটি 2010 সালের। ছয় জন ব্যক্তিকে মহাকাশ যানের মতো একটি স্থানে 520 দিন আটকে রাখা হয়েছিল। সেই যানটি কিন্তু মহাকাশে ছিল না। ছিল এই পৃথিবীতেই। এটি ছিল একটি পরীক্ষা যার উদ্দেশ্য ছিল মঙ্গলে কোনো অভিযান চালানোর সময় নভোচারীরা কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে সে বিষয়ে ধারণা অর্জন করা। পৃথিবীতে থেকেই পরীক্ষামূলক এই মঙ্গল অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছিল মার্স 500। চালানো হয়েছিল রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে। সময় লেগেছিল প্রায় দেড় বছর।
তাতে অংশ নেওয়া একজন দিয়েগো ওবিনা বলেন, শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর এর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত ছিলাম না। জানতাম না যে এরকম একটি অবস্থায় আমরা আসলে ঠিক কিভাবে সাড়া দিতে পারি। সেসব জানতে আমি খুব আগ্রহী ছিলাম। তিনি একজন মহাকাশ বিষয়ক প্রকৌশলী। 2000 সালের শেষের দিকে ইউরোপের নভোচারী সংক্রান্ত একটি কেন্দ্রে শিক্ষানবিশ হিসেবে মাত্র কাজ শেষ করেছেন তিনি।
সেসময় একটি অভিনব বিজ্ঞাপন দেখতে পান দিয়েগো। তাতে কিছু স্বেচ্ছাসেবী খোঁজ করা হচ্ছিল যাদেরকে এই পৃথিবীতেই নকল একটি মহাকাশ যানে আটকে রাখা হবে। তবে একদিন কিম্বা দুদিনের জন্য নয়। 520 দিনের জন্য। মহাশূন্যে একটি বছর কাটাতে কেমন লাগে?ছবি: মঙ্গল গ্রহ দেখতে কেমনমঙ্গল গ্রহে কয়টি অভিযান সফল হয়েছে?চাঁদের বুকে শেষবারের মত নেমেছিলেন যে নভোচারীরা স্বেচ্ছাসেবীরা কথিত ওই মহাকাশ যানের ভেতরে যেভাবে সময় কাটিয়েছেন। রাশিয়া চীন এবং ইউরোপিয়ান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা যৌথভাবে এই পরীক্ষাটি চালিয়েছিল যাতে মঙ্গল গ্রহে যেতে এবং সেখান থেকে ফিরে আসতে যতো সময় লাগবে, সেই একই সময়ের জন্য কয়েকজন মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। দিয়েগো ওবিনা বলেন, "আমার স্বপ্ন ছিল মহাকাশ বিষয়ে কাজ করা। এছাড়াও আমরা মনে হয়েছিল একজন মানুষের জীবনে এধরনের অভিজ্ঞতা তো একবারই হয়।
এই পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য আবেদন করেছিল প্রায় 40 হাজার মানুষ। তাদের মধ্য থেকে বাছাই করা হয় মাত্র ছয়জন: তিনজন রুশ, একজন ফরাসী, একজন চীনা। আর দিয়েগো একজন ইতালিয়ান-কলাম্বিয়ান। এরা সবাই প্রকৌশল কিম্বা চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন। 2010 সালের ৩রা জুন তাদেরকে একটি নকল মহাকাশ যানের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এটি ছিল মস্কোর একটি বিশাল গুদাম-ঘরের ভেতরে।
দিয়েগো বলেন, প্রথম দিন নিজেদেরকে খুবই ক্ষুদ্র মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এরকম একটি জায়গায় আমরা এতো দীর্ঘ সময় কিভাবে থাকবো! কিন্তু ধীরে ধীরে এই পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে শুরু করলাম। একেকজনের জন্য তিন বর্গমিটার জায়গা নির্ধারিত ছিল। একটা লিভিং রুম ছিল যেখানে অবসর সময়ে বিশ্রাম নিতাম। আলাদা করে একটা খাওয়ার জায়গা ছিল। দিনের একটা সময়ে আমরা সবাই একসাথে জড়ো হয়ে গল্প করতাম। ওষুধপত্র রাখার জন্য একটা জায়গা ছিল। আরেকটা জায়গা ছিল খাদ্যদ্রব্য রাখার। ব্যায়ামের জন্য কিছু যন্ত্রপাতিও ছিল। আরো ছিল ছোট্ট একটা গ্রিন হাউজ।
মহাকাশ থেকে ভারতের বাতাস কেন দেখতে ভিন্নমহাকাশ স্টেশনে রহস্যজনক এই ছিদ্রটি করলো কে?গ্রহাণুর ধাক্কা থেকে পৃথিবী 100 বছরের জন্য নিরাপদ: নাসা দেড় বছর বিচ্ছিন্ন থাকার পর সাজানো মহাকাশ থেকে বের হয়ে আসছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। এই পরীক্ষায় তাদেরকে এমনভাবে রাখা হয়েছিল যেন মনে হয় যে তারা সত্যিকার অর্থেই মঙ্গল গ্রহের অভিযানে অংশ নিয়েছেন। এসময় তারা পরীক্ষা চালাবে, কন্ট্রোল রুম থেকে বার্তা গ্রহণ করবে, বার্তা পাবে প্রিয়জনদের কাছ থেকেও। এমনকি মঙ্গলের পৃষ্ঠেও তারা অবতরণ করবে।
এসময় তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ে তার ওপর সারাক্ষণ নজর রাখা হচ্ছিল। চালানো হচ্ছিল নিয়মিত পরীক্ষা। তাদেরকে শারীরিক কিছু নমুনাও দিতে হতো পরীক্ষা করার জন্য। প্রতিদিন কিম্বা কয়েকদিন পর পর আমাদের মূত্র সংগ্রহ করতে হতো। রক্ত এবং মুখের লালা সংগ্রহ করতে হতো প্রত্যেক মাসে। এসব থেকে বোঝা যেত মানসিক চাপের কারণে শরীরে কি ধরনের হরমোন তৈরি হচ্ছে। এসব নমুনা একটি পাত্রে ভরে রাখতো হতো যা পরে পাঠানো হতো বিজ্ঞানীদের কাছে, বলেন দিয়েগো ওবিনা।
এসময় কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটতো। জরুরি কিছু পরিস্থিতিও মোকাবেলা করতে হয়েছিল তাদের। এরকম একটি ঘটনার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, "তারা আমাদের বলল যে বাইরে আগুন লেগেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হলো। সব বাতি নিভে গেল। বন্ধ হয়ে গেল কিছু ফ্রিজ। খাবার দাবার যাতে নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য আমরা ব্যস্ত হয়ে গেলাম। লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমও কাজ করছিল না। বাতাস পরিশোধনের যন্ত্রটিও বন্ধ হয়ে গেল। আমরা জানতে চাইলাম ভেতরে যে বাতাস আছে সেটা দিয়ে আমরা কতদিন বেঁচে থাকতে পারব। হিসেব করে দেখা গেল যে আরো কয়েকদিন বেঁচে থাকার জন্য সেখানে যথেষ্ট বাতাস ছিল।
কিন্তু পরে তারা জানতে পারলেন যে আসলে এরকম কোন পরিস্থিতিই তৈরি হয়নি। এটা ছিল এই পরীক্ষারই অংশ। মহাশূন্য থেকে ফেরা ক্যাপসুলে পাওয়া গেল গ্রহাণুর টুকরোমহাশূন্যের রায়ুগু গ্রহাণু থেকে আনা নমুনা থেকে যা জানা যাবেপৃথিবীর আকাশে নজর এড়িয়ে যাওয়া বিশাল অগ্নিগোলক মনিটর থেকে স্বেচ্ছাসেবীদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। দিয়েগো ওবিনা হাসতে হাসতে বললেন, "তারা বলল যে এটা একটা সাজানো বিষয় ছিল। প্রথমে আমরা সেটা বিশ্বাস করিনি। আমরা ভেবেছিলাম বাস্তবেই এমন ঘটেছে। আমাদের শান্ত করার জন্য তারা হয়তো এখন বলছে যে এটা সাজানো। এটা যে আসলেই বাস্তব ছিল না সেটা বোঝাতে তাদের তিন সপ্তাহ সময় লেগেছিল।
এখানে তারা মাসের পর মাস কাটিয়েছেন। কোন জানালা ছিল না। ছিল না সূর্যের আলো কিম্বা বাতাসের প্রবাহ। যখন কাজ থাকতো না তারা বই পড়ে, সিনেমা দেখে, ভিডিও গেমস খেলে সময় কাটাতেন। কিন্তু একঘেয়ে জীবন ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন সমস্যা ছিল সামাজিক বৈচিত্র্য না থাকা। নতুন কারো সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ ছিল না। ছিল না কোন বন্ধু। ভিন্ন কোন মত কিম্বা ভিন্ন কোন গলার স্বরও ছিল না।
আট মাস পরে তাদের মধ্যে তিনজনকে মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করার পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছিল। দিয়েগো ছিলেন তাদের একজন। এজন্য তাদেরকে একটি ল্যান্ডারে দুই সপ্তাহের জন্য আলাদা করে রাখা হয়। এরপর তারা স্পেস স্যুট পরে মঙ্গল গ্রহের পৃষ্টে নেমে আসেন। গুদাম ঘরে প্রচুর বালি ফেলে মঙ্গলের পৃষ্ঠদেশ তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু তারা সবাই এটাকে মঙ্গল গ্রহ বলেই মনে করেছিলেন।
চার দেয়ালের ভেতরে আট মাস থাকার পর আমাদের সামনে এতো বড় একটি জায়গা দেখতে পেলাম যা একেবারেই আলাদা রকমের। কিন্তু মনে হচ্ছিল এটাই যেন সবচেয়ে ভাল জায়গা। এতদিন বিচ্ছিন্ন থাকার পর মনে হচ্ছিল সত্যি যেন আমরা মঙ্গলের পিঠে হেঁটে বেড়াচ্ছি।
মঙ্গল গ্রহের বুক থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য পরে তারা বাকি তিনজনের সঙ্গে যোগ দেন। তারা যখন বুঝতে পারলেন যে এজন্য তাদেরকে আরো অনেক দীর্ঘ সময় পাড়ি দিতে হবে তখন তারা বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। কিন্তু সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে উত্তেজনাও বাড়তে শুরু করে। দিয়েগো বলেন, "আমি ভাবছিলাম পৃথিবীতে হয়তো অনেক কিছু বদলে গেছে, মানুষগুলো না জানি এখন কেমন হয়েছে। ফিরে যাওয়ার পর কী করবো- এসব নিয়ে পরিকল্পনা করতাম আমি।
প্রায় আঠারো মাস মহাকাশ যানে থাকার পর 2011 সালের নভেম্বরে এই মিশনের সমাপ্তি ঘটে। ঘরটি খুলে দেওয়া হয় এবং একজন একজন করে বাইরে বের হয়ে আসতে শুরু করেন। আমার জীবনে এতোটা উত্তেজিত আমি কখনো হইনি। তারা দরজাটা খুলল। আমরা সেখান থেকে বের হয়ে এলাম। আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছিল একদল মানুষ। তারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
দিয়েগো বলেন, একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। কারণ দেড় বছরের জন্য আমরা কোনো মানুষ দেখিনি। আমি যখন দেখলাম, তাদেরকে আমার বাস্তব মানুষ বলে মনে হয়নি। আমার পরিবারকে আবার দেখতে পেলাম। এই প্রথম আমি আবার সূর্য দেখছি, একটা কুকুর দেখতে পেলাম। এই প্রথম একটা শিশুকে দেখলাম। এটা ছিল বিশেষ এক মুহূর্ত, বলেন তিনি।
সাজানো মহাকাশ থেকে মঙ্গলে নেমেছেন দুজন স্বেচ্ছাসেবী। করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আলাদা হয়ে থাকার বিষয়টি হয়তো আমরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। কিন্তু দেড় বছরের লকডাউন থেকে দিয়েগো কী শিক্ষা নিয়েছেন? নিজের জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। সারা জীবন যেসব জিনিস শিখতে চেয়েছিলাম, যেমন ছবি আঁকতে শিখেছি, কিছুটা রুশ ভাষা শিখেছি। এই সময়ে আমি পৃথিবীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। একটা গাছ দেখলে অভিভূত হয়ে পড়েছি।
ছোট খাটো বিষয়, যেমন কাউকে দেখলে হাই বলা, অপরিচিত লোকের সঙ্গে পরিচিত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলো। পৃথিবীতে ফিরে আসার পর বুঝতে পারলাম সমাজে অন্যান্য মানুষের সঙ্গে একত্রে থাকাটা কতোখানি জরুরি," বলেন তিনি। দিয়েগো ওবিনা বলেছেন, এরকমভাবে আরেকবার বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে তিনি আর রাজি নন। তবে তাকে যদি সত্যি সত্যি মঙ্গলে পাঠানো হয়, তার জন্য তিনি প্রস্তুত আছেন।