গিজার পিরামিডের অজানা রহস্য।


মানুষ দিন দিন সভ্য থেকে সভ্যতর হয়েছে। সৃষ্টি করেছে নতুন নতুন সভ্যতা। নিজেদের তৈরী সভ্যতাকে সহস্র বছর বাচিয়ে রাখার জন্য নিজেদের মতো স্বকীয়ভাবে প্রদান করেছে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীরতে মিলিয়ন বছর ধরে বাস করা মানুষের লাখ লাখ সভ্যতা থেকে অমর হয়েছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি সভ্যতা খুব কম সভ্যতাই এখনও টিকে আছে। কিন্তু এদের মাঝে এমন কিছু ধ্বংসাবশেষ এমন আছে যেগুলো আমাদের অবাক করে।


অবস্থান

গিজার পিরামিড বলতে আমরা খুফু পিরামিডকে বুঝি। কিন্তু প্রধানত গিজার পিরামিড একটি কমপ্লেক্স বা চত্বর আকারে রয়েছে। এখানে রয়েছে 3 টি পিরামিড, দ্য গ্রেট স্ফিংক্স ও কয়েকটি সমাধি। এই চত্বরের অবস্থান মিশরের রাজধানী কায়রোর কেন্দ্র হতে দক্ষিণ পশ্চিমে প্রায় 13 কিঃমিঃ দূরে। নীল নদ থেকে এটি প্রায় 9 কিঃমিঃ পশ্চিমে গিজা মালভূমির উপর অবস্থিত।


প্রাথমিক তথ্য

প্রাচীন মিশরের রাজাদের বলা হতো ফেরাউন। মিশরীয় সভ্যতার শুরু থেকেই ফেরাউনরা তৎকালীন মিশরীয় রাজা নিজেদের রাজ্যের জন্য নতুন নতুন রীতীনীতি বানানো শুরু করে। মিশরীয়দের ধারণা ছিলো মৃত্যুই জীবনের শেষ নয়। মৃত্যুর পরেও মানুষ বেচে থাকে ও তাই দেহকে অমর করে রাখা প্রয়োজন। তাই তারা মমি বানানো শুরু করে। বিশেষ ধরনের মিশ্রণ তৈরী করে তারা মমি বানায়। কিন্তু তারা প্রথম দিকে সাধারণভাবে মমি সমাধিত করলেও পরে পিরামিড বানানোর ধারণা তৈরী হয়। তারপর থেকে পিরামিড বানিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মমি পিরামিডের ভিতর সমাধিত করা শুরু হয়। শুধু তাই নয়। মমির সাথে স্বর্ণালঙ্কার, দামি আসবাবপত্র সবকিছু পিরামিডের ভিতর রেখে আসা হতো। এরই ধারাবাহিকতায় ফেরাউন খুফু গিজার মহাপিরামিড তৈরী করেন। 481 ফুট উচু এই মহাপিরামিড 3800 বছর ধরে সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট দালানের শিরোপা ধরে রেখেছিলো সগৌরবে।


অবকাঠামো

অবকাঠামোগত দিক থেকে এই মহা পিরামিডের যত বলবো ততই কম। তবে প্রথমে আসি গিজার পিরামিড চত্বরে। এখানে খুফুর পিরামিড ছাড়াও আরও দুটি পিরামিড রয়েছে৷ এদের নাম খাফর এর পিরামিড ও মেনকৌর এর পিরামিড। খাফর এর পিরামিড গিজার দ্বিতীয় উচ্চতম এবং এর উচ্চতা 448 ফুট। তৃতীয় ও সবচেয়ে কম উচ্চতা বিশিষ্ট হলো মেনকৌর এর পিরামিড। এটি 213 ফুট উচু। আর এছাড়াও এখানে রয়েছে দ্য গ্রেট স্ফিংক্স । এটি একটি মানুষের মাথা ও সিংহের দেহবিশিষ্ট স্থাপনা। এছাড়াও এ চত্বরে তিনটি ক্ষুদ্র পিরামিড ও কয়েকটি স্যাটেলাইট পিরামিড ও রয়েছে। খুফুর পিরামিড তৈরি করা হয়েছে দুই ধরনের পাথর দিয়ে। চুনাপাথর এবং গ্রানাইট পাথরের বিশাল বিশাল ব্লক মিলে তৈরী হয়েছে এই পিরামিড। এই পিরামিডটি বানাতে প্রয়োজন হয়েছে 2.5 মিলিয়ন পাথর ব্লকের। সবচেয়ে বড় পাথর ব্লকটির ওজন প্রায় 80 টন। গ্রানাইট পাথর আনা হতো নীলনদ দিয়ে নৌকায় করে। পুরো পিরামিড টি তৈরী করতে প্রায় 5.5 মিলিয়ন টন চুনাপাথর, 8000 টন গ্রানাইট এবং 500000 টন সুরকির প্রয়োজন হয়েছিলো।


ইতিহাস

প্রাচীন মিশরের রাজা অর্থাৎ ফেরাউনদের মধ্যে পিরামিড বানিয়ে নিজের সৃতিস্তম্ভকে অবিস্মরণীয় করে রাখা খুব স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু ফেরাউন খুফু কিছুটা ব্যতিক্রম করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি এই মহাপিরামিড বানানোর কাজ শুরু করেন। ধারণা করা হয় এই পিরামিডের নির্মাণকাল খিষ্টপূর্ব 2650 সাল। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় 4000 বছর পূর্বে। কাজটি শেষ করতে সময় লেগেছিলো প্রায় 20 বছর। ধারণামতে এই মহাপিরামিডের স্থপতি ছিলো তৎকালীন ভিজিয়ের হেমিউনু। ভিজিয়ের বলতে ফেরাউনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও রাজ্যের সবচেয়ে সম্মানিত লোককে বুঝায়। তার তত্ত্বাবধানে ও সুনিপুণ কারিগরি দক্ষতার ফলে গিজার মহাপিরামিড হয়ে ওঠে প্রাচীন বিশ্বের সপ্তমাশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম।


পিরামিড রহস্য

গিজার মহাপিরামিড নিয়ে প্রধান রহস্য হলো এর স্থাপনা। এত বড় পিরামিড তৎকালীন সময়ে কোনো প্রকার আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া তৈরী করা অনেকটাই অসম্ভব মনে হয়। কয়েকশত টনের এসব পাথর ৪০০ ফুটের বেশি উপরে উঠানোর জন্য ক্রেন জাতীয় কোনো মেশিন ও ছিলোনা তখন। তাই এই পিরামিড বানানো নিয়ে রয়েছে বহু মত। অনেকে বলে এই পিরামিডটি এলিয়েনরা বানিয়েছে। অনেকের মতে এটি অলৌকিক কিছু। কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও গ্রহণযোগ্য ধারণার পেছনে রয়েছে পদার্থবিদ্যা। প্রাচীন মিশরের বিভিন্ন লেখা ও খোদাই করা চিত্রের মাঝে একটিতে দেখা যায় একদল লোক দড়ি দিয়ে ভাড়ি কিছু টেনে কিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আরেকদল লোক ঐ ভাড়ি জিনিসটির নিচে কিছু ঢেলে চলেছে। এরপর বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে ক্রীতদাসদের দিয়ে ভাড়ি পাথর টানিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো এবং অন্য ক্রীতদাসেরা ঐ পাথরের নিচে পানি ঢেলে চলতো। ফলে পানি তলের ঘর্ষণ কমিয়ে দিতো এবং পিচ্ছিল করে দিতো। এ থেকে ধারণা পাওয়া যায় সেসময়ের মিশর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারে যুগের থেকে অনেকটা এগিয়ে ছিলো।


চুনাপাথরের ব্লক

পিরামিডের বাইরের দিকের স্থাপত্য দেয়া হয়েছে চুনাপাথর দিয়ে। চুনাপাথর কেটে সঠিক মাপ দিয়ে এই পিরামিডটি বানানো হয়। চুনাপাথর এর কাটার মাপ এমন হতে হয়েছিলো যাতে পিরামিডের বাইরের দিকে এটি মসৃণ দেখায়। কিন্তু প্রাচীন মিশরে কলাকৌশল দেখে বিজ্ঞানীরা আজও হতবাক। আমরা হয়তো ভারী যন্ত্রপাতি দিয়েও যা বানাতে পারবোনা তারা খালি হাতেই তা বানিয়ে ফেলেছিলো। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় ত্রিডি ড্রয়িং এর মাধ্যমে দেখানো হয় যে আগে পিরামিডের ভিতরের অংশ তৈরী করে পরে বাহিরের অংশ তৈরী করা হয়। ভিতরের অংশকে 3 টি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো কিংস চেম্বার, আরেকটি হলো কুইন্স চেম্বার ও তৃতীয়টি হলো গ্র‍্যান্ড গ্যালারি।


পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আসসালাম অলাইকুম

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post