সাধারণভাবে "ইন্টারনেট অফ থিংস" হলো প্রযুক্তি, যা প্রতিটি ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসকে ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত করবে। প্রয়োজনীয় ডিভাইসগুলো একটি নেটওয়ার্কে পারস্পরিক সংযুক্ত থাকবে এবং প্রয়োজনে ডিভাইসগুলো একে অপরের সাথে যোগাযোগ এবং তথ্য আদান প্রদান করে পরিকল্পনা করতে পারবে। সেই ক্ষেত্রে পুরো সিস্টেমটিই সেন্সর যুক্ত মেশিন এবং সফটওয়্যার সমন্বয়ে তৈরি হবে এবং নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহৃত মেশিনটি ব্যবহারকারীর উপর নির্ভর না হয়ে নিজে নিজেই কাজ করতে পারবে। এখানেই ভবিষ্যত ইন্টারনেট অফ থিংসেএর সার্থকতা।
নিচে দুটি উদাহরণ দেওয়া হলো
ধরুন, বিকেলে বাসায় মেহমান আসবে। কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে বেশ রাত পর্যন্ত অফিসে থাকতে হবে। বাসায় এমন কেউ নেই যে আগত মেহমানদের জন্য দরজা খুলে দেবে। অফিস দূরে হওয়ায়, অল্প সময়ের জন্য এসে আত্মীয়দের বরণ এবং আপ্যায়ন করার সুযোগও নেই। অফিসের কাজে দূরদূরান্তে থাকার কারণে বিভিন্ন সময়ই এই সমস্যাটির সম্মুখীন হতে হয়। তার সমাধান হিসেবে স্মার্ট প্রযুক্তি নির্ভর বাড়িতে নতুন প্রোগ্রাম ইনস্টল করলেন। এটি আগত মেহমানদের চেহারা এবং কণ্ঠস্বর চিহ্নিত করার পর দরজা খুলে দেবে এবং বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করা মেহমানদের শরীরের তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে ঘরের পরিবেশকে আরো আরামদায়ক করে তুলবে! সাথে সাথে স্থানীয় আবহাওয়া বিশ্লেষণ করে কফি মেকারটি ঠাণ্ডা আবহাওয়ার জন্য গরম কফি এবং গরম আবহাওয়ার জন্য ঠাণ্ডা কফি মেহমানদের পরিবেশন করবে।
এবার ধরুন, বিশাল একটি গরুর খামার। নির্দিষ্ট সময় পরপর সেখানে প্রয়োজনীয় খাদ্য শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সেখানে পানির ব্যবস্থা করতে হয়। এর জন্য বিশাল লোকবল প্রয়োজন। প্রয়োজন এমন কয়েকজন কর্মচারীর, যারা সার্বক্ষণিক এর তত্ত্বাবধানে থাকবে। যদি খামার আয়তন বড় হয়, গরুর সংখ্যা বেশি থাকে, তাহলে কর্মচারীর সংখ্যাও বাড়াতে হবে। তার জন্য মাস শেষে গুনতে হবে বিশাল অংকের টাকা। কিন্তু এরপরেও সমস্যা রয়ে যায়। কর্মচারীদের দ্বারা নিয়মিত প্রায় পুরো খামার জুড়ে সঠিক সময়ে খাবার এবং পানি দেওয়া হয়ে ওঠে না। এমনকি পরিমাণে কম, কখনো বেশিও হয়ে যায়। ফলাফল হিসেবে দেখা যায়, নির্দিষ্ট সময় পর আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। অথবা খরচের পরিমাণ হিসেবের চাইতে বেশি হয়ে যাচ্ছে।
প্রযুক্তিবিদ এক বন্ধুর সাথে সমস্যাটি নিয়ে কথা বলতেই সে পুরো সিস্টেমটিকে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসতে বলল, যেটি নির্দিষ্ট সময় পরপর খাবার এবং পানির পরিমাণ বিশ্লেষণ করে পুনরায় খাবার, পানি দিবে। চাইলে প্রত্যেকটা গরুর জন্য প্রত্যাশা অনুযায়ী আলাদা আলাদা নির্দিষ্ট ডায়েটের ব্যবস্থাও করে দিতে পারেন এই সক্রিয় সিস্টেমের মাধ্যমে।
পুরো সিস্টেমটি কিভাবে কাজ করলো তা নিচে ব্যাখ্যা করা হলো।
প্রথম উদাহরণে, ব্যবহারকারী প্রথমে শুধুমাত্র আগত মেহমানদের শনাক্তকরণ উপাদান হিসেবে তাদের কণ্ঠস্বর এবং ছবি ইনপুট দিয়েছে। এরপর যখন মেহমানরা বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো, তখন আগে থেকে স্থাপিত ভয়েজ এন্ড ফটো শনাক্তকারী যন্ত্রটি আলাদা করে তাদের প্রত্যেকের ভয়েজ এন্ড ফেশিয়াল আইডেন্টিটি ইনপুট নিলো এবং আগে ইনপুট করা তথ্যের সাথে সাদৃশ্য হলেই ভিতরে ঢোকার জন্য দরজা খুলে দিলো। ভিতরের স্বয়ংক্রিয় সেন্সরগুলো পরবর্তী কাজ করবে। সেন্সরগুলো প্রথমে শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করবে। সে অনুযায়ী ঘরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং কমানো, সর্বশেষ কফি মেকারটিকে ঠাণ্ডা কিংবা গরম কফির অর্ডার দেওয়ার কাজটিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে হবে। পুরো ব্যাপারটি নিয়ে আবার চিন্তা করলে দেখতে পারি, প্রত্যেকটা কাজের জন্য আলাদা আলাদাভাবে "হিউম্যান-টু-হিউম্যান" এবং হিউম্যান-টু-মেশিন তথ্য এবং নির্দেশাবলী আদান প্রদান করা ছাড়াও অনেকগুলো কাজ খুব সহজেই পর্যাপ্ত পরিমাণে হয়ে যাচ্ছে। আর এই কাজগুলোতে অংশ গ্রহণ করছে ফ্রিজ, টিভি, ফোন, লাইট, সেন্সর-যুক্ত দেয়াল, এসি, পাখা, ঘড়ি, গাড়ি সহ প্রায় সব ধরনের ব্যবহার্য ইলেকট্রিকাল ডিভাইস।
যে কারণে ইন্টারনেট অফ থিংস এর প্রয়োজন
"ইন্টারনেট অফ থিংস" ধারণাটি নিয়ে প্রথম আলোচনা করা হয় 1982 সালের দিকে। "Carnegie Mellon University" এর কয়েকজন গবেষক মিলে প্রথম ইন্টারনেট কানেক্টেড কোক মেশিন তৈরি করেন, যেটি নতুন লোড করা কোকাকোলার তাপমাত্রা বিস্তারিত বলতে পারবে। কিন্তু "ইন্টারনেট অফ থিংস" উল্লেখ করে এ ব্যাপারে প্রথম বক্তব্য রাখেন এমআইটির "Auto-ID" সেন্টারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী পরিচালক ক্যাভিন এশটন। মাল্টি-ন্যাশনাল প্রোডাক্ট ম্যানুফেকচার কোম্পানি "Procter Gamble" এ দেওয়া ঐ বক্তব্যে "ইন্টারনেট অফ থিংস" এর সম্ভাব্য ক্ষেত্র নিয়ে তিনি আলোচনা করেন। “বর্তমানে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট পুরোপুরি মানুষের দেওয়া তথ্যের উপর নির্ভরশীল।
50 পেটাবাইটের ( 1 পেটাবাইট = 1024 টেরাবাইট ) মতো ডাটা ইন্টারনেটে সংগৃহীত রয়েছে যার প্রায় পুরোটাই কেউ না কেউ লিখে, রেকর্ড করে, ডিজিটাল ফটোগ্রাফের মাধ্যমে, নয়তো বারকোড স্ক্যান করে স্টোর করেছে। তবে সমস্যা হচ্ছে মানুষ সীমিত সময়, অল্প মনোযোগ এবং খুব কম যথাযথতা নিয়ে জীবন ধারণ করে। অর্থাৎ তারা দুনিয়ার সব ধরণের ডাটা সঠিকভাবে স্টোর করতে পারে না। কিন্তু যদি কাজটি কোনো কম্পিউটারকে দেওয়া হয় এবং শিখিয়ে দেওয়া হয়, কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিকটি বাছাই করা যায়, তাহলে বাছাইকৃত তথ্যগুলো মানুষ খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারবে এবং সাথে সাথে অপব্যয়, খরচ এবং ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারবে। তখন নির্ভুলভাবে জানতে পারবো কোন জিনিসটিকে পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং প্রতিস্থাপন করতে হবে।
কেভিন এশটন "ইন্টারনেট অফ থিংস" সম্পর্কে উপরোক্ত ভবিষ্যদ্বাণীটি করেছিলেন আরো আঠারো বছর আগে। বর্তমানে ইন্টারনেটের এই দুনিয়ায় আরো পরিবর্তন এসেছে। 50 পেটাবাইট ডাটার সাথে যোগ হয়েছে আরো হাজার হাজার পেটাবাইট ডাটা। শুধুমাত্র মাইক্রোসফট, গুগল, আমাজন এবং ফেসবুকের ডাটার পরিমাণই 1200 পেটাবাইট। তাহলে ভাবুন একবার, কী পরিমাণ ডাটা রয়েছে ইন্টারনেট জুড়ে! আর এর থেকে নির্ভুল ডাটা উদ্ধার করে যদি ব্যক্তিগত বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাজে ব্যবহার করতে পারি তাহলে কী পরিমাণ কর্মক্ষম এবং সহজ হয়ে উঠবে পৃথিবী। কেভিন এশটনের মতে যা ছিল একটি শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়া কম্পিউটার যার ব্যবস্থা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে নির্ভুল ডাটা সনাক্ত করে বিভিন্ন প্রয়োজনে ডাটাগুলোকে ব্যবহার করতে পারব।
এখন বর্তমান টেকনোলজির দিকে একবার তাকান। দিন দিন ফিজিক্যাল ডিভাইসের পরিমাণ বাড়ছে। কম্পিউটারের আদি যুগ সেই কবেই চলে গেছে। বর্তমানে কম্পিউটার একটি আধুনিক "ওয়ারে-বল ফ্যাশনে" পরিণত হয়েছে। চারপাশে অসংখ্য স্মার্টফোন, অপারেটিং সিস্টেম সম্বলিত ঘড়ি, বাড়ি, গাড়ি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকুইপমেন্টগুলোও অটোমেশনের আওতায় চলে যাচ্ছে। আশেপাশের পরিবেশ দেখতে কেমন তা সবই ঘরে বসে স্মার্টফোনের স্ক্রীনে দেখতে পারবেন। কিন্তু এখানে সমস্যা হচ্ছে, প্রত্যেকটি ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসকে দিয়ে কাজ করানোর জন্য প্রয়োজন তাকে প্রত্যেকটা একক কাজের জন্য আলাদা আলাদা নির্দেশ দেওয়া, যা বেশ সময় সাপেক্ষ এবং টেকনিক্যাল কাজ। আর এ সমস্যাটি সমাধান করেছে "ইন্টারনেট অফ থিংস"।
এখানে নেটওয়ার্কে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত ডিভাইসগুলো ইন্টারনেটের বিভিন্ন স্টোরেজে থাকা ডাটা, ব্যবহারকারীর ইনপুট দেওয়া ডাটা এবং নিজের সংগ্রহ করা ডাটাগুলোকে একে অপরের সাথে শেয়ার করবে। এই ডাটাগুলোর মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় ডাটা নির্দিষ্ট কাজের জন্য ব্যবহার করবে এবং স্টোর করে রাখবে যাতে অন্য কোনো অবস্থায়, অন্য কোনো কাজে ডাটাগুলোকে ব্যবহার করতে পারে। পুরো বিষয়টি বিবেচনা করলে দেখা যায়,"ইন্টারনেট অফ থিংস" একটি প্রযুক্তি বিপ্লব, যা কঠিন কঠিন কাজগুলো খুব সহজেই করে দিবে। পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে অপব্যয় এবং খরচ কমিয়ে আনবে। প্রচুর পরিমাণে সময় বাঁচিয়ে দিবে।
বর্তমান পৃথিবীর "ইন্টারনেট অফ থিংস"
পৃথিবীব্যাপী "ইন্টারনেট অফ থিংস" প্রযুক্তির জয়জয়কার এখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে। বড় বড় কোম্পানিগুলো স্বল্প এবং বৃহৎ পরিসরে কাজও শুরু করে দিয়েছে। কিছু কোম্পানি ছোট পরিসরে আইওটি সংবলিত ডিভাইস বাজারে ছেড়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কিছু ডিভাইস নিয়ে এখন আলোচনা করা হলো।
Fitbit One- Wearables
ফিটবিট নামের আমেরিকান কোম্পানিটি ফিটনেস সম্পর্কিত প্রযুক্তি পণ্য বিক্রি করে থাকে। "Fitbit One" হচ্ছে ঐ সকল প্রযুক্তি পণ্যগুলোর মধ্যে একটি। সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা, হাঁটাচলা, ঘুমের পরিমাণ এবং উৎকর্ষতা, ব্লাড প্রেশার পরিমাপ করবে এবং সে অনুযায়ী ফিটনেস ঠিক রাখার জন্য পরামর্শ দিবে।
Amazon Echo- Smart Home
আমাজনের এই প্রোডাক্টটিকে কথা বলার মাধ্যমে আদেশ করতে পারবেন। জেনে নিতে পারবেন বর্তমান আবহাওয়া, খেলার স্কোর, কোনো বিশেষ নিউজ পেপারের সম্পাদকীয় কলাম। চাইলে পছন্দের কোনো গান বাজানোর জন্য আদেশ করার সাথে পিজ্জা অর্ডারও করতে পারবেন। উবারের জন্য আবেদন করা, বিশেষ কাউকে ফোন করা, বাড়ির ইলেকট্রিকাল ডিভাইসগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা সহ আরো অনেক কাজ করতে পারবেন।
Philips Hue Smart Bulbs
প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ছায়াতলে এসে সাধারণ ইলেক্ট্রিক্যাল বাতিও আজ হয়ে উঠেছে অসাধারণ। "Philips Hue Smart Bulbs" তার একমাত্র উদাহরণ হতে পারে। ইলেকট্রিকাল পণ্য প্রস্ততকারক কোম্পানি ফিলিপসের এই বাতিটি স্মার্টফোনের মাধ্যমে অন-অফ করা সহ চাইলেই ইচ্ছে মতো রঙ-বেরঙের আলো জ্বালাতে পারবেন। ঘরের পরিবেশ, পরিধানরত পোশাকের সাথে ম্যাচ করা আলোর মধ্যে ছবি তোলার সুযোগও রয়েছে। এটি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ীও বটে।
ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসের প্রতি মানুষজন আরো বেশি ঝুঁকবে। প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনের সংখ্যাও বেড়ে যাবে। ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর দাম কমে যাওয়া প্রায় প্রত্যেকের কাছে ইন্টারনেট কানেক্টেড "স্মার্ট ডিভাইস" থাকবে। পুরো পৃথিবীটা একটি "গ্লোবাল-ভিলেজে" রূপান্তরিত হবে। নিরাপত্তা এবং অন্যান্য পুরো ব্যাপারটিই যেহেতু তথ্যের খেলা এবং এই খেলা যখন খেলতে হবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে, সেহেতু নিরাপত্তার বিষয়টি প্রথমেই আসে।
কেননা, যেকোনো সময় মূল্যবান তথ্য চুরি যেতে পারে, যার কারণে পুরোপুরি ফতুরও হয়ে যেতে পারেন। আর এই বিষয়টিই আইওটির অগ্রসর হওয়ার অন্তরায় থাকবে। কেননা মানুষ নিজস্ব প্রাইভেসির ব্যাপারে বেশ উদ্বিগ্ন থাকে সব সময়। এক গবেষণায় দেখা গেছে তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর দেশ আমেরিকার স্মার্ট-হোম সুবিধা ভোগকারী প্রায় 71 শতাংশ গ্রাহক তাদের তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এর কারণও আছে বটে। "মাইক্রোসফট" এবং "University of Michigan" এর একদল গবেষক "স্যামসাংয়ের" স্মার্টহোম প্লাটফর্ম স্মার্টথিংসে বড় ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন, যা তথ্যের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি।